দেনমোহর কী, কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এবং পরিশোধ সংক্রান্ত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

0


দেনমোহর কী, কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এবং পরিশোধ সংক্রান্ত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি



ভূমিকা:

দেনমোহর (মোহর) ইসলামী বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অংশ। এটি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি একটি সম্মানসূচক উপহার, যা বিবাহের সময় নির্ধারিত হয় এবং পরবর্তীতে পরিশোধযোগ্য থাকে। মোহর পরিশোধ না করা ইসলামী শরিয়তে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমান সময়ে মুদ্রাস্ফীতির কারণে মোহরের প্রকৃত মূল্য হ্রাস পেতে পারে, যা পরিশোধের সময় বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করে। এই প্রবন্ধে মোহরের ইসলামী বিধান, মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব এবং পরিশোধের নৈতিকতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।​


মোহরের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব:

ইসলামী শরিয়তে মোহর হলো সেই নির্ধারিত সম্পদ বা অর্থ, যা স্বামী বিবাহের সময় স্ত্রীর জন্য নির্ধারণ করে এবং পরবর্তীতে পরিশোধ করে। এটি স্ত্রীর অধিকার এবং স্বামীর ওপর একটি বাধ্যতামূলক ঋণ। মোহর পরিশোধ না করা কবিরা গুনাহ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি স্ত্রীর ন্যায্য পাওনা। বিবাহের সময় মোহর নির্ধারণ করা এবং যথাসময়ে তা পরিশোধ করা স্বামীর দায়িত্ব।​


মোহর পরিশোধে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব:


বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মুদ্রাস্ফীতি একটি সাধারণ ঘটনা। মুদ্রার মান হ্রাস পাওয়ার ফলে পূর্বে নির্ধারিত মোহরের প্রকৃত মূল্য কমে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, মোহর পরিশোধের সময় মুদ্রাস্ফীতির হিসাব করা উচিত কি না।​


ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে, মোহর একটি নির্দিষ্ট ঋণ, যা পরিমাণগতভাবে নির্ধারিত। মুদ্রাস্ফীতির কারণে এর মূল্য হ্রাস পেলেও, পরিশোধের সময় মূল নির্ধারিত পরিমাণই পরিশোধ করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক নয়।​


ফিকহি দৃষ্টিকোণ

ইসলামী ফিকহ অনুযায়ী, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে মূল নির্ধারিত পরিমাণই পরিশোধ করতে হয়, মুদ্রাস্ফীতির কারণে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের প্রয়োজন নেই। যদি স্বামী স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করেন, তবে তা প্রশংসনীয়, কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়।​


দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া

দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া অনুযায়ী, মোহর পরিশোধের সময় মুদ্রাস্ফীতির হিসাব করা প্রয়োজন নেই। বিবাহের সময় যে পরিমাণ মোহর নির্ধারিত হয়েছে, তা-ই পরিশোধ করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।​


নৈতিকতা ও পারিবারিক সম্পর্ক

যদিও মুদ্রাস্ফীতির কারণে মোহরের প্রকৃত মূল্য হ্রাস পেতে পারে, তবুও স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করেন, তবে তা নৈতিকভাবে প্রশংসনীয়। এটি পারিবারিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে সহায়ক হতে পারে।​


 দেনমোহর সংক্রান্ত প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)


১. মোহর কী?

উত্তর: মোহর হলো স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত অর্থ বা সম্পদ, যা বিবাহের সময় বা পরবর্তী সময়ে প্রদান করতে হয়। এটি ইসলামী বিবাহের অপরিহার্য অংশ এবং স্ত্রীর বৈধ অধিকার।


২. মোহর না দিলে কি বিবাহ বৈধ হয়?

উত্তর: মোহর নির্ধারণ না করলে ইসলামী দৃষ্টিতে বিবাহ পূর্ণাঙ্গ হয় না। এটি বিবাহের একটি শর্ত, যদিও পরিশোধ সময় সাপেক্ষে হতে পারে।


৩. মোহর কি বিবাহের সময় পরিশোধ করতেই হবে?

উত্তর: উত্তম হলো বিবাহের সময়ই মোহর পুরোপুরি পরিশোধ করা। তবে তা পরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া যেতে পারে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে নমনীয়তা দিয়েছে।


 ৪. স্ত্রী কি মোহর মাফ করে দিতে পারেন?

উত্তর: হ্যাঁ, স্ত্রী যদি নিজের ইচ্ছায় (স্বতঃস্ফূর্তভাবে) মোহর মাফ করে দেন, তবে তা গ্রহণযোগ্য। তবে স্বামীর চাপ বা প্রতারণার মাধ্যমে তা আদায় করা নাজায়েজ।


৫. মোহর পরিশোধ না করলে কী হয়?

উত্তর: এটি গুনাহের কাজ। মোহর স্ত্রীর ওপর স্বামীর একটি ঋণ হিসেবে গণ্য হয়, যা চুকানো ফরজ। মৃত্যুর পরও এটি মৃত ব্যক্তির সম্পদ থেকে আদায়যোগ্য।


৬. স্বামী যদি মোহর না দিয়ে মারা যান?

উত্তর: তাহলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে মোহর আদায় করে স্ত্রীকে দিতে হবে, যেভাবে অন্য দেনা শোধ করা হয়।


৭. তালাকের পরে মোহর কি পরিশোধ করতে হয়?

উত্তর: হ্যাঁ, তালাকের পরে স্বামী মোহর পরিশোধে বাধ্য। তালাক মোহর মাফের কারণ নয়, যদি না স্ত্রী ইচ্ছায় তা মাফ করে দেন।


৮. মোহর পরিশোধে মুদ্রাস্ফীতি কি বিবেচনায় নিতে হবে?

উত্তর: ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী, মুদ্রাস্ফীতি ধর্তব্য নয়। যে পরিমাণ টাকা মোহর নির্ধারণ করা হয়েছিল, ঠিক সেই পরিমাণই দিতে হবে, বাড়তি মূল্য সংযোজন বাধ্যতামূলক নয়।


৯. স্বামী যদি এখন ২০ বছর পর মোহর দিতে চান, তাহলে কত টাকা দেবেন?

উত্তর: বিবাহের সময় মোহর যদি ২ লাখ টাকা নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে এখন ২০ বছর পরও সেই ২ লাখই দিতে হবে, এমনকি মুদ্রাস্ফীতির কারণে টাকার মূল্য কমে গেলেও।


১০. স্ত্রী কি মোহরের পরিবর্তে অন্য কিছু নিতে পারেন?

উত্তর: হ্যাঁ, পারস্পরিক সম্মতিতে মোহরের পরিবর্তে স্বর্ণ, জমি, সম্পদ, বা অন্য উপহার গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে তা স্ত্রীর সম্মতির ভিত্তিতে হতে হবে।


১১. মোহর কি শুধু টাকা হতে হবে?

উত্তর: না, মোহর নগদ অর্থ ছাড়াও সোনা, জমি, সম্পত্তি, শিক্ষাদান, হজে পাঠানো ইত্যাদিও হতে পারে, যা যৌক্তিক ও স্ত্রীর উপযোগী হয়।


১২. খুব কম পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা জায়েজ কি?

উত্তর: শরিয়ত মোতাবেক স্বল্প মোহর নির্ধারণ করা জায়েজ, তবে তা যেন স্ত্রীর মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি সুবিচার করে।


১৩. মোহরের টাকা কিভাবে আদায় করা যায়?

উত্তর: ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক স্ত্রী চাইলে মোহরের টাকা আদায় করতে পারেন। প্রয়োজনে স্থানীয় ইসলামি পরামর্শক, সালিশি বোর্ড বা আদালতের সহায়তা নিতে পারেন।


১৪. স্ত্রী মারা গেলে মোহর কি বাতিল হয়ে যায়?

উত্তর: না। স্ত্রী মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীরা মোহরের পাওনা দাবি করতে পারেন। এটি তার সম্পত্তির অংশ হয়ে যায়।


১৫. মোহর পরিশোধ না করলে কিয়ামতের দিন কী হবে?

উত্তর: এটি একটি অপরিশোধিত ঋণ হিসেবে থাকবে। কিয়ামতের দিন এর জবাবদিহি করতে হবে। হাদীসে এসেছে, ‘ঋণশোধ না করে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না ঋণ শোধ করা হয়।’



মোহর ইসলামী বিবাহের একটি অপরিহার্য অংশ এবং এটি স্ত্রীর অধিকার। মুদ্রাস্ফীতির কারণে মোহরের প্রকৃত মূল্য হ্রাস পেলেও, ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে মূল নির্ধারিত পরিমাণই পরিশোধ করতে হবে। স্বামী যদি স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করেন, তবে তা প্রশংসনীয়, কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। মোহর পরিশোধের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও নৈতিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।​


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top