তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন: ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে অপচয়ের প্রকল্প
২০০৯ সালে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি উন্নত, প্রযুক্তিনির্ভর জাতি গঠনের প্রত্যয়ে। এর আওতায় দেশে শত শত তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এতদিন পর এসে দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রকল্পের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় হলেও ফলাফল তেমন দৃশ্যমান নয়। বরং সেই অর্থ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, ভুল পরিকল্পনা ও দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট।
অতিরিক্ত ব্যয় ও জমির অপচয়
প্রকল্প: আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার
তদন্তে উঠে এসেছে, আটটি জেলায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে মাত্র কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিতে প্রয়োজন ছিল ছোট পরিসরের ভবন। কিন্তু সেখানে দোতলা ভবনের পরিবর্তে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হয়, যা প্রকল্প ব্যয়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণে খরচ: ১৩ কোটি টাকা
অতিরিক্ত ভবন নির্মাণে খরচ: ১১০ কোটি টাকা
মোট প্রকল্প ব্যয়: ৫৩৪ কোটি টাকা
এমন ব্যয় প্রকল্পের লক্ষ্য পূরণে কোনো কার্যকর অবদান রাখেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
🏫 প্রশিক্ষণকেন্দ্রের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ
২০১৭ সালের প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই ব্যবহার করা হচ্ছে না। নতুন প্রকল্পেও একই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ১৪টি জেলায় নির্মিত ভবনগুলোর মধ্যে অনেক জায়গায় জনবল নিয়োগই হয়নি। কোথাও কোথাও প্রশিক্ষণার্থীও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে ১,১১৫ কোটি টাকা।
চুক্তি ছাড়াই প্রকল্প শুরু: ডিজিটাল সংযোগ
চীনের অর্থায়নে ৫,৯২৩ কোটি টাকার ‘ডিজিটাল সংযোগ’ প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঋণ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই প্রকল্পের কাজ শুরু করে দেওয়া হয়, যা প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় চরম উদাসীনতা ও নিয়মবহির্ভূত আচরণের প্রমাণ।
তদন্ত কমিটির মতামত:
প্রকল্পটি বাতিলযোগ্য
৪,০৭৫ কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব অপ্রয়োজনীয় খাত বাদ দিলে
ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির নামে বিলাসিতা
শিবচরে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি’ স্থাপনে নেওয়া হয়েছে ১,৫৩৪ কোটি টাকার প্রকল্প। এতে ৭০ একর জমি অধিগ্রহণে ২০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, যা প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে আগে প্রযুক্তি ও শিক্ষাগত প্রস্তুতির প্রয়োজন, শুধু বিল্ডিং দিয়ে শিক্ষা হয় না।”
তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ
তদন্ত কমিটি ২১টি প্রকল্প বিশ্লেষণ করে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করেছে:
প্রধান অভিযোগসমূহ:
অতিরিক্ত ব্যয়: বাস্তব প্রয়োজনের চেয়ে বহুগুণ বেশি বরাদ্দ
ভুল প্রকল্প পরিকল্পনা: যে জায়গায় জনবল বা প্রশিক্ষণার্থী নেই, সেখানেই প্রশিক্ষণকেন্দ্র
অনেক ভবন খালি পড়ে আছে
সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে প্রযুক্তি পৌঁছায়নি
প্রকল্পের অডিট রিপোর্টের অভাব
🔸 সুপারিশ:
ভবিষ্যতে বিনিয়োগের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ বাধ্যতামূলক করা
জনবল ও প্রশিক্ষণব্যবস্থা নিশ্চিত না করে অবকাঠামো নির্মাণ না করা
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
📉 আর্থিক ব্যর্থতা বনাম ডিজিটাল স্বপ্ন
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এখন অনেকটাই ম্লান। উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের নামে করা এইসব ব্যয়ের পেছনে তেমন কোনো প্রযুক্তিগত অগ্রগতি চোখে পড়ে না। বরং জনগণের করের টাকায় গড়ে ওঠা বিলাসী অবকাঠামো এখন পরিণত হয়েছে ‘ডিজিটাল অপচয়ে’র প্রতীক।
🧾 সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি কোথায়?
এই প্রকল্পগুলো অনুমোদনের সময় যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা এখন কোথায়? কেউ কি জবাব দিয়েছেন? এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
সরকারি টাকা মানে জনগণের টাকা। সেই টাকার এমন অপচয় রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রতি জনগণের আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
🙋♂️ FAQ (সচরাচর জিজ্ঞাসা)
প্রশ্ন ১: ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য কী ছিল?
উত্তর: তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন ও ব্যবসায়ে উন্নয়ন ঘটানো এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন।
প্রশ্ন ২: এই প্রকল্পগুলোতে কী ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে?
উত্তর: অতিরিক্ত ব্যয়, জমি ও ভবন অপচয়, প্রকল্প শুরুতে ঋণ না থাকা, জনবল ও কার্যকারিতা ছাড়া নির্মাণ ইত্যাদি।
প্রশ্ন ৩: কোন প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে?
উত্তর: ডিজিটাল সংযোগ প্রকল্পে ৫,৯২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, তবে তা এখন বাতিলযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রশ্ন ৪: তদন্ত কমিটি কী সুপারিশ করেছে?
উত্তর: প্রকল্প গ্রহণে বাস্তব প্রয়োজন যাচাই, স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা, অডিট বাধ্যতামূলক করা।
প্রশ্ন ৫: এ থেকে আমাদের কী শিক্ষা নেওয়া উচিত?
উত্তর: উন্নয়ন প্রকল্পে কাগজে-কলমে নয়, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা যাচাই করে পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার ধারণা। কিন্তু তার সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করে সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনার ওপর। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—স্বপ্ন দেখাই যথেষ্ট নয়, সঠিক পথে এগোতে না পারলে তা দুঃস্বপ্নেও পরিণত হতে পারে।
ব্লগটি যদি ভালো লেগে থাকে, তাহলে শেয়ার করুন ও মন্তব্যে আপনার মতামত জানান।
মূল প্রতিবেদন পড়তে এখানে যান: প্রথম আলো প্রতিবেদন