![]() |
উচ্চ রক্তচাপ কেন হয় এবং কারা এতে বেশি আক্রান্ত হন? |
হাইপারটেনশন, বা উচ্চ রক্তচাপ, হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে রক্ত চাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে। এটি ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন হৃদয়, মস্তিষ্ক, কিডনি ও চোখের ক্ষতি করতে পারে এবং হৃদরোগ, স্ট্রোক বা কিডনি ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ায়।
উচ্চ রক্তচাপ কীভাবে হয়?
১. রক্তনালী সংকোচন বা স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস: বয়স বাড়ার সঙ্গে রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়, ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
২. অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ: খাবারে অতিরিক্ত লবণ থাকলে শরীরে সোডিয়াম জমে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
৩. জেনেটিক বা বংশগত কারণ: পরিবারে কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে অন্য সদস্যদেরও ঝুঁকি থাকে।
৪. অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন রক্তনালীর ওপর চাপ বাড়ায়।
5. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: একটানা বসে থাকা বা ব্যায়ামের অভাব রক্তচাপকে প্রভাবিত করে।
6. ধূমপান ও অ্যালকোহল: এগুলো রক্তনালী সংকুচিত করে এবং হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে রক্তচাপ বাড়ায়।
7. চিন্তা বা স্ট্রেস: অতিরিক্ত মানসিক চাপেও অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
8. ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ: এই রোগগুলো রক্তচাপের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
- যাদের বয়স ৪০ বা তার বেশি
- যাদের পরিবারে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস আছে
- স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন যাদের আছে
- ধূমপায়ী ও অ্যালকোহল গ্রহণকারীরা
- ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ বা হরমোনজনিত সমস্যায় ভুগছেন
- যারা অনিয়মিত জীবনযাপন করেন (ঘুমের অভাব, মানসিক চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাবার)
- শারীরিকভাবে যারা অলস বা নিষ্ক্রিয়
স্ট্রোক কেন হয়? লক্ষণ ও ঝুঁকি এড়ানোর উপায় কী?
স্ট্রোক সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে:
ইস্কেমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke) – মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমে ব্লক হয়ে গেলে এটি ঘটে (প্রায় ৮০-৮৫% ক্ষেত্রে)।
হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke) – রক্তনালি ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে ঘটে।
স্ট্রোকের সাধারণ কারণগুলো: উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)
- ডায়াবেটিস
- ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান
- হৃদরোগ (যেমন অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন)
- উচ্চ কোলেস্টেরল
- অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ
স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ (Warning Signs)
স্ট্রোক হঠাৎ করেই হয়ে থাকে, তাই তাৎক্ষণিক লক্ষণগুলো জানা জরুরি। মনে রাখুন: FAST টেস্ট
F – Face Drooping: মুখের একপাশ ঝুলে পড়ে বা হাসতে কষ্ট হয়।
A – Arm Weakness: এক হাত দুর্বল হয়ে পড়ে বা তুলতে না পারা।
S – Speech Difficulty: কথা জড়িয়ে যাওয়া বা স্পষ্টভাবে না বলা।
T – Time to call emergency: এই উপসর্গগুলো দেখলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
অন্যান্য লক্ষণ:
হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখা বা দৃষ্টিশক্তি হারানো
ভারসাম্য হারানো বা মাথা ঘোরা
তীব্র মাথাব্যথা (বিশেষ করে হেমোরেজিক স্ট্রোকে)
স্ট্রোক এড়ানোর উপায় (Prevention Tips):
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধান কারণ।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করুন: রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ করুন: এগুলো রক্তনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সুস্থ খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন: লবণ, চর্বি ও চিনি কম খেতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন: ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
স্ট্রেস কমান: যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা শখের কাজ করতে পারেন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন: রক্তচাপ, সুগার, কোলেস্টেরল চেক করা জরুরি।
উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক গাইডলাইন
বাংলাদেশের সরকারের উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক একটি গাইডলাইন আছে, যাতে কম ওষুধ সেবন করে এবং জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এই গাইডলাইন তৈরির সাথে ছিলেন অধ্যাপক জামান, তিনি বলেছেন গাইডলাইনের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশব্যাপী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রক্তচাপ পরিমাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সেইসঙ্গে একটি চার্ট বা টেবিল করে দেয়া হয়েছে, যেখানে উচ্চ রক্তচাপ কত থাকলে কী ব্যবস্থা নিতে হবে, এবং কী ওষুধ খেতে হবে, সেগুলো চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীর ব্যায়াম
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত উপকারী। এটি রক্তচাপ কমাতে ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়তা করে। তবে ব্যায়াম শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি সব ধরনের শারীরিক ব্যায়ামই করতে পারবেন, তবে কিছু নিয়ম ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন রোগীর বয়স, ওজন, উচ্চতা ও সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে ব্যায়ামের তীব্রতা নির্ধারণ করা।
যে ব্যায়াম করতে পারেন
● হাঁটা সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ ব্যায়াম। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটলে হৃদ্যন্ত্রের উপকার হয়। প্রাথমিকভাবে ধীরগতিতে শুরু করে ধীরে ধীরে গতি বৃদ্ধি করুন।
● সাইকেল চালানো একটি কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম, যা হৃদ্যন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মিনিটের জন্য সাইকেল চালান।
● সাঁতার পেশির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও শরীরের ওপর কম চাপ সৃষ্টি করে। সপ্তাহে দু-তিন দিন দৈনিক ৩০ মিনিটের জন্য সাঁতার কাটুন।
● যোগব্যায়াম রিল্যাক্সেশন ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক। বিভিন্ন স্ট্রেচিং ও শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। প্রতিদিন সকালে ২০ থেকে ৩০ মিনিট যোগব্যায়াম করুন।
● অ্যারোবিক ব্যায়াম হৃদ্যন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মিনিটের জন্য জগিং, নাচ বা জাম্পিং জ্যাকস করুন।
● হালকা ওজন উত্তোলন মাংসপেশির শক্তি বৃদ্ধি করে এবং শরীরের ফিটনেস বাড়ায়। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মিনিট এ ব্যায়াম করুন।
সতর্কতা
● ব্যায়ামের আগে-পরে রক্তচাপ পরীক্ষা করুন।
● ব্যায়ামের সময় সঠিক পোশাক ও জুতা পরুন।
● পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
● ধীরে ধীরে ব্যায়ামের মাত্রা বাড়ান।
● অস্বস্তি বা সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কখন ব্যায়াম নিষিদ্ধ
● রোগীর রক্তচাপ খুব বেশি হলে (১৮০/১১০ এমএমএইচজি বা এর বেশি)।
● যদি উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন বা অ্যারিদমিয়া থাকে।
● কোনো কোনো রক্তচাপের ওষুধ শুরু করার পর আকস্মিক রক্তচাপ কমে যাওয়ার প্রবণতা হয়। নতুন কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করলে সাময়িকভাবে ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
● ব্যায়াম করার সময় বুকব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অত্যধিক মাথাঘোরা বা অচেতন হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিলে অবিলম্বে ব্যায়াম বন্ধ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
●গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ থাকলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া অন্য জটিলতা, যেমন জ্বর, সংক্রমণ, হৃদ্রোগ, কিডনির সমস্যা ইত্যাদি থাকলে ব্যায়াম করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
উচ্চ রক্তচাপের জন্য ঔষধ
উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেসার) নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাধারণত কয়েক ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই ওষুধ গ্রহণ করা উচিত নয়। নিচে কিছু সাধারণভাবে ব্যবহৃত উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের নাম ও তাদের কার্যপ্রণালী দেওয়া হলো:
উচ্চ রক্তচাপের জন্য ব্যবহৃত সাধারণ ওষুধের ধরন
ডায়ুরেটিক্স (Diuretics)
কাজ: শরীর থেকে অতিরিক্ত লবণ ও পানি বের করে দেয়, ফলে রক্তচাপ কমে।
উদাহরণ: Hydrochlorothiazide, Furosemide
বিটা ব্লকার (Beta Blockers)
কাজ: হার্ট রেট কমিয়ে দেয় এবং হার্টকে আরাম দেয়।
উদাহরণ: Atenolol, Metoprolol, Propranolol
এইস ইনহিবিটরস (ACE Inhibitors)
কাজ: রক্তনালিকে প্রশস্ত করে রক্তচাপ কমায়।
উদাহরণ: Enalapril, Lisinopril, Ramipril
ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকারস (Calcium Channel Blockers)
কাজ: রক্তনালিকে আরাম দেয় ও রক্তচাপ কমায়।
উদাহরণ: Amlodipine, Nifedipine, Diltiazem
এআরবি (ARBs - Angiotensin II Receptor Blockers)
কাজ: রক্তনালির সংকোচন রোধ করে।
উদাহরণ: Losartan, Valsartan, Telmisartan
আলফা ব্লকার (Alpha Blockers)
কাজ: রক্তনালিকে প্রশস্ত করে।
উদাহরণ: Doxazosin, Prazosin
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
ওষুধ শুরু করার আগে অবশ্যই ডাক্তারকে দেখান।
রক্তচাপ নিয়মিত মাপুন।
ওষুধ ছাড়াও লাইফস্টাইল পরিবর্তন (খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, মানসিক চাপ কমানো) খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান পরামর্শদাতা:
এম ইয়াছিন আলী, চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালট্যান্ট, ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা